আমি বললাম, "না আঙ্কেল, আমি রোযা রেখে বেশি খেতে পারি না। ইফতারের পর রাতে তো খাই-ই না।"
আন্টি বলেন, "খাও তো বাবু, একদিন খেলে কিছু হয় না। এইটুকু খাওয়া যায়। খাও।"
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে হলেও খেলাম। কি আর করব, আঙ্কেল আর আন্টি কে তো না করতে পারছি না। বলে রাখা ভাল, আঙ্কেল আমাদের (রাফিয়ার বন্ধুদের) খুব আদর করেন। আন্টি-ও। তিনি আমাদের বাবু বলেই সম্বোধন করেন।
সাধারণত আমি রোজার সময় ইফতারের পর কিছু খাই না। কারণ খাওয়ার মত অবস্থাই থাকে না। আবার ভোর রাতে সেহরি করতে হয় না! একজন মানুষ কত আর খেতে পারে। আর আমি এমনিতেই একটু মোটা হয়ে যাচ্ছি। তাই চেষ্টা করছি যাতে রোযার মধ্যে একটু শুকানো যায়... তা আর পারলাম কই? প্রতিদিন-ই নতুন নতুন উছিলা দিয়ে এত্ত এত্ত খাবার খাচ্ছি। খাওয়া কন্ট্রোল-ই করতে পারছি না।
যাই হোক, অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। খেতেই হল। কারণ আঙ্কেল চাচ্ছেন না আমাকে এম্নিতেই ছেড়ে দিতে। তার এত বড় একটা কাজ করে দিলাম। আঙ্কেল হচ্ছেন আমার বন্ধু রাফিয়ার বাবা। গতকাল (২৩ আগষ্ট ২০১০) বিকেলে আমার ভার্সিটি যাবার কথা ছিল। মাত্র প্লান করছিলাম, তখনি রাফিয়ার ফোন এল।
বলল, "আমার ফুপ্পির কিডনি ডায়ালাইসিস হবে, রক্ত লাগবে। তুমি কি দিতে পারবা?"
আমি বললাম, "হা পারব। কখন আর কোথায় দিতে হবে বল।"
রাফিয়া বলল, "আমি ঠিকানাটা এসএমএস করছি, তুমি সন্ধ্যার পর চলে এস।"
আমি বললাম, "ঠিক আছে। আমি চলে আসব।"
অফিস শেষ করে ভার্সিটি না গিয়ে সোজা বাসায় গেলাম। আম্মুকে বললাম আমার রক্ত দিতে যাবার কথা।
আম্মু একটু নিচু গলায় বলল, "তুমি রক্ত দিবা? তোমার শরীরে এম্নিতেই রক্ত নেই। আর রোযা রেখে রক্ত দেয়া লাগবে না।"
আমি বললাম, "আমার শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত আছে, রক্ত দিলে রক্ত আবার হয়ে যায়। কমে থাকে না। আর আমি তো এখনি যাচ্ছি না। রোযার পর ইফতার শেষ করেই যাব।"
আম্মু আর বেশি জোর করতে পারল না।
এখানে একটু বলে নেয়া ভাল, আম্মু কেন আমাকে নিয়ে এই কথাটা বলল। কারণ হচ্ছে, আমার একবার গ্যাস্ট্রিক-এর প্রবলেম দেখা দেয়। প্রচন্ড রকমের সিরিয়াস প্রবলেম। আমার ব্যাথাটা এত বেরে যায় যে ডাক্তার আমাকে হসপিটালাইজড্ করতে বলেন। যেইদিন আমাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হবে, তার থিক আগের দিন আমার বেথা এত বেড়ে যায়, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার এখনও খেয়াল আছে, আমি উঠে টয়লেট যাবার জন্য হাঁটা শুরু করতেই আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমি জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলি। সেই রাতেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন পর আমার জ্ঞ্যান ফেরে। সেই রাতে বমির সাথে আমার শরীর থেকে প্রায় ৫ ব্যাগ রক্ত বেরিয়ে যায়। এখানে বলাবাহুল্য যে, একজন মানুষের শরীরে ৬ ব্যাগ রক্ত থাকে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, আমার গ্যাষ্ট্রিকের সমস্যাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ওই মুহূর্তে চিকিৎসা না হলে ভাল হওয়ার চান্স কম ছিল। তখন আমি ক্লাস ৭-এ পড়ি। আল্লাহর রহমতে আমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ এবং আমার গ্যাস্ট্রিক নিয়ে আর কোন সমস্যা হয় নি। এখন বুঝলেন তো, আম্মু কেন টেনশন করছিল?
যাই হোক, আমি ইফতারের পর নামায শেষ করে রওয়ানা দিলাম ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। বাস, রিকশা, যখন যেটা পেলাম, যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। গিয়ে পৌঁছুলাম প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যে। রাস্তা মোটামুটি খালি-ই ছিল। ইফতারের পর তো, তাই।
"এইতো বাবু চলে এসেছে।"
"স্লামাইকুম আঙ্কেল"
"কই! বাবু এসেছে। চলো আমরা ডাক্তারের কাছে যাই।"
"চলেন আঙ্কেল।"
ডাক্তার প্রথমে স্যাম্পল নিলেন। আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর ডেকে আমাকে শোয়ালেন এবং রক্ত নেয়া শুরু করলেন। আমি এইবার-ই যে প্রথম রক্ত দিচ্ছি তা নয়। আগেও দিয়েছি। আমার প্রথম রক্ত দেয়া হয় ২০০৮-এ। একুশে বইমেলায়। আমার কেন জানি সন্দেহ হয়, ওরা আমার থেকে ১ ব্যাগ-এর কথা বলে ২ ব্যাগ রক্ত নিয়েছিল (সত্য-মিথ্যা জানি না)। কারণ আমার অনেক খারাপ লাগছিল তখন। হাঁটতে পারছিলাম না।
সেইবার রক্ত দেয়ার অনেকদিন পর আমার আরেক ক্লাসমেট-এর মা-র জন্য রক্ত দিয়েছিলাম। এরপর আরেকজনকে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরে আর লাগেনি। তাই আমার রক্ত দেয়ার অভিজ্ঞতা ২ বারের। যাই হোক, রক্ত নেয়া শুরু হল। প্রথমে যখন সুঁই ঢোকায় তখন একটু ব্যাথা লাগে। এরপর আর কোন কিছু টের পাওয়া যায় নি।
"আঙ্কেল আপনি বসেন তো। আমার চাইতে বেশি আপনি টেনশন করছেন।"
"না বাবু, তুমি এত কষ্ট করছ।", আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। "এইটুকু বয়সে এরা কত বড় কাজ করছে।"
"অন্যের রক্ত নেয়ার থেকে নিজেদের রক্ত নেয়াই তো ভাল।", আন্টি বললেন।
এরপর যার জন্য রক্ত দিলাম, তাকে দেখতে গেলাম। এক্কেবারে শুকিয়ে গেছেন। কিডনি প্রবলেম হয়েছে ওনার। ধানমন্ডির কিডনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ডায়ালাইসিসের জন্য ও-পজিটিভ ব্লাড দরকার। তাই আমাকে তলব। রোগীকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত সুস্থ একটা মানুষ, কিভাবে... ...
এদিকে, আঙ্কেল আমাকে পারলে কোলে তুলে নিচে নামিয়ে আনে। আমাকে ধরে রেখেছেন তিনি, যাতে পড়ে না যাই। আমি তাকে বললেও তিনি বিশ্বাস করছেন না যে আমি সুস্থ আছি। তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন স্টার কাবাব-এ। আমাকে সামনে বসিয়ে পেট ভরে খাইয়ে দিয়ে তারপর ক্ষ্যান্ত হলেন।
রক্ত দেয়ার কথাটা নিয়ে এতগুলো কথা বললাম, কারণ বস্তুত এইটাই আমার পরিপুর্ণ রক্ত দেয়ার প্রথম কাহিনী। প্রথমবারের রক্ত দেয়া ছিল ব্লাড ক্যাম্পে। দ্বিতীয়বারেরটা রোগীর লাগবে কিনা ঠিক ছিল না। আর এইবার রোগীর প্রয়োজনে তার পাশে থেকে রক্ত দিলাম। ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, জীবনে একটা কাজ করলাম।
রক্ত আল্লাহ-র এমন একটা দান, যা মানুষ একজন আরেকজনকে দিয়ে তার জীবন বাঁচানোর মত মহান কাজে অংশ নিতে পারে। আল্লাহ মানুষকে যে অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন, এইটা তার মধ্যে একটি। এই রমজানে মানুষের ছোট ছোট সওয়াবগুলোও আল্লাহ অনেক বড় করে বান্দাকে ফিরিয়ে দিবেন। আর রক্ত দেয়া কোন অংশেই ছোট কাজ নয়। একজন মানুষের জীবন বাঁচানো অনেক মহৎ একটি কাজ।
নিজের মনের মধ্যেই ভালো লাগছে। খুব হাল্কা লাগছে আজ নিজেকে।
"অন্যের রক্ত নেয়ার থেকে নিজেদের রক্ত নেয়াই তো ভাল।"
ReplyDeleteএই কথাটাকে আমি অন্যভাবে দেখার প্রয়াস পেয়েছি:
"অন্যের রক্ত নেয়ার চেয়ে নিজের রক্ত বিলিয়ে দেয়াই তো ভালো।"
আমাদের জন্য, যুব সমাজের জন্য এই কথাটার বড় দরকার।
সরি, কথাটার বোধহয় আরেকটু ব্যাখ্যা দরকার ছিল। এইখানে আন্টি অন্যের রক্ত বলতে অপরিচিত লোকের রক্ত বোঝাতে চেয়েছেন। আর নিজের রক্ত বলতে পরিচিত লোকের কথা বলতে চেয়েছেন।
ReplyDelete(আমি আগেই বলেছি যে, আমি ভালো লিখতে পারি না) :)